Saturday, October 31, 2020

 

খেলনা বন্দুক বা মায়ের কথা

ঋষিগোপাল মণ্ডল

 


মায়ের মৃতদেহের সামনে বসে মনে মনে বলেছিলাম , মা ওঠো । ওঠেনি মা । বরং , না চাইতেই মায়ের মাথার পাশে রজনীগন্ধার কুঁড়ি ফুটে উঠেছিল অস্ফুটে । তেমন কবি নই । বিশ্বাস করো , তাই , অন্য কবির কথা ধার করে বলেছিলাম , ওড়নার পাশে সেফটিপিন হোক । অণূঢ়া বন্ধুনীদের গায়ে হলুদ হোক । পড়শির ঘরে মেয়ে হোক । ক্ষুধার্তের শস্যস্বপ্নে রেশনের মোটা চালের ভাত হোক । অন্তত লালস্বর্ণ । মিনিকেট , বাঁশকাঠি আর বাসমতী না হয় তোমরাই খেয়ো।

 

সপ্তমীর সন্ধ্যায় কার্জনগেটের উল্টো ফুটপাথে রেলিঙে হেলান দিয়ে বসেছিল দু’জন ঢাকি । তখনও কেউ বায়না করেনি ওঁদের তখনও না । আর ছিল দু’জন হাফপ্যান্ট পরা ছেলে । কাঁসরবাদক । যেমন থাকে সব ঢাকির সাথেই । ওঁদের এই পুজোয় আদৌ কেউ বায়না করেছিল কি না , জানা হয়নি । যে মেয়ে বায়না করেছিল , আমায় নিয়ে , শুধু আমায় নিয়েই দু’ লাইন লিখে দেবে ঋষি ! তাকে আমি আগ বাড়িয়ে চার লাইন লিখে দিয়েছি...যেভাবে বৃষ্টি নামে ঝুপ করে/ কিচ্ছুটি না জানিয়ে ভেজায় তুমুল/ ঠিক সেভাবে বা তার কাছাকাছি/ ভেজে মফঃস্বল আর টেরাকোটা দুল । এত আলফাল লেখালিখির মাঝে ‘বায়না’ শব্দের ঠিকঠাক মর্মার্থ জানা হলো না আমার

অথচ ‘তিল’ শব্দের ব্যঞ্জনা জানবো বলে কত দুপুরকে নিজের হাতে বিকেল করেছি তা আর কেউ না জানুক চিলেকোঠার নির্জন আর দিদিমণির নখপালিশ জানে । নখপালিশকে নেলপলিশ বলে যারা , তাদেরই একজন একবার পুজোয় খেলনাবন্দুক কিনে দিয়েছিল । গোল ক্যাপ বারবার লোড করতে হতো বলে ম্যাগাজিনে একেবারে রিল ক্যাপ ভরে নিতাম । বারুদের গন্ধ আর ধোঁয়া পেরিয়ে দেখতাম দুর্গা অসুরের বুকে ত্রিশুল গেঁথে দিয়েছেন । গ্যালগ্যাল করে রক্ত বের হচ্ছে অসুরের পায়ের নিচে মোষের কাটা মাথা আর নবমীর খাসির দোকানে মাংসের জন্য মানুষের লাইন পেরিয়ে যে লাল , তার কাছাকাছি লালে লাল হয়ে অনেকে আজকাল বিজয়া দশমীর ছবি পোস্ট করে । এসব থেকে অনেক দুরের একটা প্যান্ডেলে কিশোরকুমার খালিপিলি গাইতে থাকেন , ইয়ে লাল রঙ কব মুঝে...এসব দেখে শুনে সব বালক সংঘ ক্রমে কিশোর সংঘ বা তরুণ সংঘ হয়ে ওঠে পাড়া বেপাড়ায়।

লাল গিয়ে সবুজ এসেছে বলে , কিংবা সবুজ গিয়ে গেরুয়া আসবে বলে যারা কিনে রাখছে ডিজাইনার পাঞ্জাবি , তাদের ফটোসেশন থেকে বহু দূরে সুদান , সিরিয়া , ইয়েমেন , কঙ্গো বা ইরাকে ঐ কাঁসরবাদক বালকের বয়সী ছেলেরা হাতে তুলে নিচ্ছে কালান্তক কালাশনিকভসে পাড়ার বারুদের গন্ধ আর আমার খেলনাবন্দুকের বারুদের গন্ধ একাকার কি না তা বোঝার আগেই কালোকুলো রোগা সিরিয়ান মা কিশোর মিলিট্যান্টের হাত ধরে বলছে , খোকা যাসনে ।

ঐ মায়ের মুখ আর রজনীগন্ধার ফুটে ওঠার পাশে চিরঘুমে থাকা আমার মায়ের মুখ হুবহু এক ।

পুজো এলে তোমার কথা কথা খুব মনে পড়ে মা ।

ছবিঃ ইন্তারনেটের সৌজন্যে